Tuesday, February 7, 2012

হাইকু

হাইকু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হাইকু ( একবচনে "হাইকি") একধরনের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা । তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৭, ৫ এবং ৭ জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস মিলে মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি মুহূর্তে ঘটিত মনের ভাব প্রকাশ করা হয় । জাপানি হাইকু একটি লাইনে লিখিত হয় । সেই বাক্যটিতে ১৭টি মোরাস থাকে। সাধারণত একটি ছবি বর্ণনা করার জন্য হাইকু লিখিত হয় । মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয় । ইউরোপিয়গণ ১৭ মোরাসকে ১৭ দল মনে করে হাইকু লেখার সূত্রপাত করে । তাদের দেখাদেখি বাংলা ভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয় । মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী । সেই অনুজায়ী ১২ মোরাসে ১৭ সিলেবল হয় । ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরো বেশী সিলেবলের হাইকু লেখা শুরু হয়েছে । জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক । তাঁরা ১৭ দল ও তিন বাক্য্ বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লিখেছেন ।
  • কোবায়িশি ইশার হাইকু: জোনাকি উড়ে যায়/এত দ্রুত এত নিঃশব্দে/আলোটুকু ফেলে যায়
  • মাৎসুও বাশোর হাইকু: প্রজাপতি আতর মাখছে/নিজের ডানায়/অর্কিডের সুবাস
    • য়োসা বুসন-এর হাইকু: কুঠারের এক ঘা/পাইনগাছের গন্ধ/শীতের বনানীতে

হাইকুর ইতিহাস

  • ব্যাশোপূর্ব কাল (১৫-১৬ শতক)
  • ব্যাশো মাৎসুউ (১৬৪৪-১৬৯৪)
  • বুসন ইয়োসা (১৭১৬-১৭৮৩)
  • শিকি মাসাওকা (১৮৬৭-১৯০২)
  • কিওশি তাকাহামা (১৮৭৪-১৯৫৯)
  • ইপাকিরো নাকাৎসুকা (১৮৮৭-১৯৪৬)
  • সেকিতেয়ি হারা (১৮৮৯-১৯৫১)
  • হিসাজো সুগিতা (১৮৯০-১৯৪৬)
  • সুজু তাকানো (১৮৯৩-১৯৭৬)
  • কাকিয়ো তোমিজাওয়া (১৯০২-১৯৬২)
  • কোয়ি নাগাতা (১৯০০-১৯৯৭)

Sunday, February 5, 2012

হাইকু : একটি আন্দোলন একটি কাব্য-ঐতিহ্য

হাইকু : একটি আন্দোলন একটি কাব্য-ঐতিহ্য

- সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান

হাইকু কাব্য জাপানের রাজ দরবারে ৯ম শতকে সৃষ্ট তাংকা কাব্যের পথ ধরে এসেছে। তাংকা ৯ম থেকে ১২শ’, এই তিন শতক জুড়ে জাপানে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে চলেছিল এর বিবর্তন। ধর্ম ও রাজন্যবর্গের বিষয়াবলী নিয়ে রচিত তাংকা মূলত ছিল পাঁচ পঙিক্তর, ৫-৭-৫-৭-৭ শব্দগুচ্ছের। এই যুগে একটি কবিতা ধারাবাহিকভাবে লেখা হতো, কেউ লিখতেন প্রথম তিন পঙিক্ত (৫-৭-৫), অন্য কবি তার বাকি ৭-৭ শব্দের দুই পঙিক্ত সংযুক্ত করতেন। এরপর ভিন্ন একজন কবি ৭-৭ শব্দের পঙিক্তর সঙ্গে যোগ করতেন আরও ৫-৭-৫ শব্দের আরও তিনটি পঙিক্ত। এই শিকল পদ্ধতির সংযুক্ত কবিতা রচনাবলীকে বলা হতো রেংগা। যা অনেক সময় শতাধিক তাংকার সংযোজনে গড়ে উঠত।

কবিতার প্রথম অংশকে বলা হতো হোক্কু বা উদ্বোধনী কবিতা। এই সুরের উপরেই গড়ে উঠত মূল কবিতা। হোক্কুর কবিতার কবিরা পরবর্তী কবিদের কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান ও সম্ভ্রম লাভ করেছেন। উনিশ শতকের মধ্যে, মাসাওকা শি-কি’র সময় থেকে হোক্কু পৃথক কবিতা হিসেবে রচিত ও পাঠ করা হতে থাকে। এই হোক্কু থেকেই বর্তমানের হাইকু শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।
হোক্কুর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে বাশো, বুসন ও ইস্সা জাপানের ইদো-যুগে২ কাব্য রচনা করে গেছেন। এখনও তাদের রচনা বর্তমানের কবিদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে, এবং সেই পদ্ধতি অনুকরণ করে হাইকু কবিতা লেখা হয়। এই তিনজন কবিই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, প্রকৃতি ও মানুষের আচার-ব্যবহার এবং চরিত্রকে গভীরভাবে অবলোকন করেছেন ও এই কাব্য পদ্ধতির উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং এই শিল্প মাধ্যমের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। পরিভ্রমণকারী-কবি পদ্ধতি জাপানের একটি অতি দীর্ঘ ঐতিহ্য-লালিত সংস্কৃতি, এর অধীনে কবি সারা দেশে ভ্রমণ করে প্রকৃতি, সমাজ ও ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই তিনজন কবি সেই প্রাচীন ধারাই অনুসরণ করে গেছেন।
বাশো মাত্সুও (১৬৪৪-১৬৯৪)-কে হাইকু-র জনক হিসেবে মনে করা হয়। তিনি যুবক বয়সে তাও-ধর্ম ও চীনা কাব্য নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। প্রথম জীবনে তিনি প্রশস্তিমূলক হাস্যরসাত্মক ও নাটকীয় আবহের কবিতা লেখেন, পরে প্রচলিত জাপানি পদ্ধতি ভেঙে নির্মোহ হয়ে উঠলেন। তিনি জাপানের গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করতে লাগলেন এবং পর্যটনবিষয়ক রচনার পাশাপাশি তাংকা লিখতেন। ১৬৮০ সাল নাগাদ তিনি তার জ্ঞান ও চিন্তাচেতনা কেন্দ্রীভূত করে হাইকাই এবং বিশেষভাবে হাইকু লেখায় মনোনিবেশ করেন। চতুর্থ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের দার্শনিক চৌয়াং-সিউয়ের আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত হন।
বাসো তার হোক্কুতে চৌয়াংয়ের রচনাবলী থেকে সংগৃহীত বাক্য ব্যবহার করেছেন। তার হাইকু নাটকীয়তা, কৌতুক, বিষাদ, আনন্দ ও বিভ্রান্তিতে ভরপুর, সেই সঙ্গে তার কবিতার নাটকীয় অভিব্যক্তি পরস্পরবিরোধী স্বভাবের। শেষ জীবনে তিনি কারুমী (হালকা) জীবন যাপনের চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি তিনি তার একটি কবিতায় লিখেছেন এভাবে—বালুময় তীরবেষ্টিত অগভীর নদীর দিকে তাকিয়ে থাকা। কবিতায় তিনি যে কৌতুক ও বিষাদ প্রকাশ করেন তা মানবজীবনে সম্ভব বলে বিশ্বাস বা মহিমান্বিত করা যায় না। বাসোর সাহিত্যে এমন একটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে যে তিনি যতই মানব চরিত্রের কার্যকরণের বর্ণনা দেন, ততই মানব অস্তিত্বের ক্ষুদ্রত্ব প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকৃতির অপার শক্তি সম্পর্কে আমরা সচেতন হয়ে উঠি।
জাপানি সাহিত্যের (এবং বাশোর) সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি হাইকুর উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এ কবিতাটির কথা তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—
জাপানি উচ্চারণে ইংরেজি অনুবাদ বাংলা অনুবাদ
ফুরুইকে ইয়া ঙষফ ঢ়ড়হফ পুরনো পুকুর
কাওয়েআজু তোবিকোমু ধ ভত্ড়ম ষবধঢ়ং রহ ব্যাঙ দিলো ঝাঁপ
মিজু নো অতো ধিঃবত্থং ংড়ঁহফ জলের শব্দ।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ইংরেজি অনুবাদে দ্বিতীয় পঙিক্ততে যে রহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, বাংলা অনুবাদে সে দ্যোতনা আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই শব্দটি দিয়ে কবি একটি ধাঁধা তৈরি করেছেন—ব্যাঙটি কি সত্যিই পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে?
ফুজি পর্বত থেকে একটি বাতাস ঘোড়ার পিঠে ঘুম
আমি পাখায় বন্দি করে রাখি কিংবা দূরের চাঁদের চোখে স্বপ্ন
এখানে, ইদো-র একটি স্মারক। ভাজা চায়ের ধোঁয়া।


হেমন্তের চন্দ্রালোক বিদ্যুতের চমক
একটি পোকা খুঁড়ে চলেছে কিংবা কতকগুলি মুখ ভেবেছি যা
কাঠবাদামের খোল। সেগুলো পাম্পাস ঘাসের গুচ্ছ।
তানেগুচি বুসন (১৭১৬-৮৩) একজন প্রসিদ্ধ চিত্রকর ছিলেন। কবিতার সঙ্গে তিনি কিছু চিত্রকল্প যুক্ত করতে পছন্দ করতেন। বুসন বাশোর চেয়ে আরও বেশি জীবনাশ্রয়ী ছিলেন।
একটি বৃদ্ধ
কেটে তুলছে যব
দেহ তার কাস্তের মতো বাঁকা।
কোবায়শি ইস্সা৩ (১৭৬৩-১৮২৭) হাইকু কবিতার তৃতীয় বিখ্যাত কবি। ইস্সা একজন প্রকৃতিবাদী কবি, সকল প্রকার প্রাণীর প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা, বিশেষ করে বুকে হাঁটে যে সব প্রাণী। তার বহু রচনা ছিল রসিকতায় পূর্ণ।
ভয় পেয়ো না মাকড়সা
আমার বাসস্থল
অপরিষ্কার।
হাইকুর মূল সূত্র চারটি—প্রথমত, এটিকে হতে হবে সহজ, স্পষ্ট এবং রূপাশ্রয়ী বা নির্বস্তুক শব্দের ব্যবহার বর্জিত; দ্বিতীয়ত, স্বল্পকালস্থায়ী অন্তর্দৃষ্টি বা মুহূর্তের চিত্রায়ন থাকতে হবে, যা ‘সাতোরী’ (ংধঃড়ত্র) বা ‘আহা মুহূর্ত’ (ধযধ সড়সবহঃ) হিসেবে চিহ্নিত; তৃতীয়ত, স্মৃতিতে জাগরুক রাখতে একটি ‘কিগো’৪, সাধারণত কবিতার প্রথম বা তৃতীয় পঙিক্ততে থাকতে হবে; এবং চতুর্থত, কবিতায় একটি কেন্দ্রীয় বা বেদনার্ত শব্দ থাকতে হবে, যা কবিতার মধ্যে একটি গতির সৃষ্টি করবে।
হাইকু এমন একটি কাব্য ধারা যার সঙ্গে আধ্যাতিকতা ও বৌদ্ধ দর্শন, বিশেষ করে, জেন বুদ্ধত্ববাদ জড়িত। জেন বুদ্ধত্ববাদ জেজেন (উপবেশন ধ্যান) হিসেবে গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে জেন (চীনা ভাষায় চেন) মহাযান ধারা থেকে সৃষ্ট। বলা হয়ে থাকে জেন পদ্ধতি পালনকারী দেহের সব চেতনা আলোকিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো একটি চেতনা আলোকিত করা থেকে বিরত থাকবেন। প্রকৃত জেন বৌদ্ধধর্মের—বুদ্ধ (শিক্ষক বা শিক্ষাধারা), ধম্ম (ধর্ম বা জ্ঞান) এবং সঙ্ঘ (বৌদ্ধ গোষ্ঠী)৫—এই তিনটি মূল সূত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন।
ষোল শতকে রেংগার বদলে—রসিকতাপূর্ণ কবিতা হাইকাই যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হাইকাই কবিতা (হাইকাই-রেংগা), রেংগার মতো, ১৭ ও ১৪ শব্দসমষ্টি নিয়ে গড়ে তোলা হতো। কিন্তু এটিতে রেংগার ব্যঙ্গ করে আধুনিক অশ্লীল হাস্যরস সংযোজন করা হতো। হাইকাই-এর কবিরা শব্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন এবং রেংগা কবিতায় দৈনন্দিন জীবনের যে সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল না, সেগুলো নিয়ে এ কবিতা লেখা হতো। রেংগা ও হাইকাই-এর প্রথম পঙিক্তকে বলা হতো হোক্কু। অনেক সময় হাইকাই কবিরা তাদের হোক্কুকে স্বাধীন একটি কবিতা হিসেবে সৃষ্টি করতেন আর এভাবেই হাইকুর সৃষ্টি। ঐতিহ্যগতভাবে রেংগা ও হাইকাই কবিতার প্রথম পঙিক্ততে একটি ‘কিগো’ সংযুক্ত করা হতো। আর এ কারণে কবিরা হোক্কুতেও একটি ‘কিগো’ সংযুক্ত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। যেমন—
ছোট্ট পাখির বাসা বৃষ্টির মতো দেখতে
দুলছে লিনডেন ফুল
প্রদর্শনীর আয়নার মতো। নড়ছে।
(কোটোরি নো সু ইউরেরু কাগামি নো ইওনা ইচি) (আমে-মোয়ো বেদাইযু
নো হানা য়ুজোকি-দাসু)
- নিজি ফুয়ুনো — রিয়ু ইয়ত্স্যুয়া।
উনিশ শতকের হাইকু কবিদের মধ্যে মাসাওকা শি-কি (১৮৬৭-১৯০২) বাসো মাত্সুওর একজন সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘বাসো যাত্সুদান’ নামক গ্রন্থে তিনি বাসোর বিখ্যাত হাইকুর সমালোচনা করেন। বাসোর সব রচনারই তিনি বিরোধিতা করেননি, তবে তার হোক্কুগুলোতে কাব্যিক পবিত্রতার অভাব রয়েছে এবং গদ্যধর্মী ব্যাখ্যার প্রকৃতি উপস্থিত বলে মত প্রকাশ করেন। অন্যদিকে তিনি বুসন য়োসার প্রশংসা করেন, যদিও তখন পর্যন্ত তিনি অপরিচিত ছিলেন। তার মতে বুসন-এর হাইকুগুলো প্রায়োগিক দিক দিয়ে পরিশীলিত এবং কবিতাগুলো দক্ষভাবে পাঠকদের স্পষ্ট চিত্রকল্প উপহার দেয়। পশ্চিমা দর্শনের আবিষ্কারের পর শি-কি মন্তব্য করেন বস্তুর সাহিত্য ও চিত্রকল্পের জন্য প্রতিমাশ্রয়ী বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ‘শাসেই’-এর (স্কেচ) উপর গুরুত্বারোপ করেন। শি-কির রচিত হাইকু সমগ্র জাপানে যথেষ্ট উদ্দীপনার জন্ম দেয়। শি-কি হাইকাই-রেংগা কবিতাকে মূল্য দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি সব সময় হাইকাই কিংবা হোক্কুর স্থলে হাইকু শব্দটি ব্যবহার করতেন। আজকাল হাইকাই-রেংগাকে ‘রেংকু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞ এই কাব্য ধারার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেননি।
ইষদুষ্ণ বৃষ্টি পড়ছে আজ অত্যন্ত শীত!
উন্মুক্ত কাঁটাটির উপর। বৃষ্টিতে একটি চিংড়ি
পাইন গাছ বেয়ে উঠছে।
কিয়োশি তাকাহামা (১৮৭৪-১৯৫৯) ১৮৮৯ সাল থেকে হোটোটোগিশু৬ হাইকু পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। প্রথম জীবনে মূলত উপন্যাসের দিকে ঝুঁকে থাকলেও তিনি ১৯১৩ সাল থেকে হাইকু লেখায় মনোনিবেশ করেন। অনেক হাইকু লেখক তাকে অনুসরণ করে হাইকু লেখেন এবং তার অনুসারী হয়ে ওঠেন। কিয়োশির হাইকুতে ব্যবহৃত শব্দগুলো নানা জটিলতায় সমৃদ্ধ—অনেকটা মাঠভর্তি নানা ধরনের ও বর্ণের বন্যফুল আর ঘাসের মতো। কিয়োশি ‘কিগো’ শব্দের প্রতীকী ক্রিয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এবং ঋতুবিবর্জিত হাইকুকে সম্পূর্ণ বাতিল করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
একটি সাপ দ্রুত অপসৃত হলো মানুষ এটাকে বলে সাদা পিওনী
কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকা তার চোখ ঠিকই আছে, কিন্তু
ঘাসের ফাঁকে পড়ে রইলো। এতে আছে লালের ছোঁয়া।
ঐ দেখা দিয়েছে বছরের প্রথম প্রজাপতি নদীর দিকে তাকিয়েছিলাম
কোন রঙের? একটি কলার ছিলকা
হলুদ। আমার হাত থেকে পড়ে গেলো।
চেরী গাছ থেকে ঝরে পড়া একটা ফুল আমি ধরলাম
খুলে দেখি
ভেতরটায় কিছু নেই।
ইপোকিরো নাকাত্স্যুকা (১৮৮৭-১৯৪৬) এবং তাইশো (১৯১২-১৯২৬) কবির সময়ে অনেকেই হাইকুর ঐতিহ্যবাহী ভাষার সঙ্গে কথ্য ভাষা মিশিয়ে হাইকু লেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, ঐতিহ্যবাহী ভাষা অত্যন্ত উঁচু মানের ভাব আর কথ্য ভাষা থেকে অনেক দূরের বলে আধুনিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন এ ভাষায় সম্ভব নয়। সমন্বয় সাধনের প্রয়াস তাই অবধারিত হয়ে উঠেছিল।৭ হাইকু এমন এক সাহিত্যিক ঐতিহ্যে গড়ে উঠেছিল যে, প্রাচীনপন্থী কবিরা মনে করতেন কথ্যভাষায় একে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। প্রাচীন ধারায় যেখানে ৫ বা ৭ অক্ষরমালা ব্যবহার করা হতো, কথ্য ভাষায় সে অক্ষরমালা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ৬ বা ৮। ইপোকিরো এই ধারার বিরোধিতা করে কথ্য ধরন চালু করেন। তার হাইকুগুলো ১৭ অক্ষরমালার বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এবং তিনি ‘উন্মুক্ত হাইকু’ কবিতার সূত্রপাত করেন। ইপোকিরো ‘কিগো’র ব্যবহারও বাতিল করে হাইকু লেখকদের ব্যক্তিগত ধারা গড়ে তুলতে পরামর্শ দেন।
একজন সিক্ত সেবিকা
একটু থেমে ঝুড়িভর্তি জলজ প্রাণীর দিকে তাকালো
তারপর আবার হাঁটতে থাকল।
সেকিতেই হারা (১৮৮৯-১৯৫১) কিয়োশি তাকাহামা সম্পাদিত হোটোটোগিশু পত্রিকার কল্যাণে অনেক উল্লেখযোগ্য হাইকু কবির আত্মপ্রকাশ হয়। প্রথম ধারায় কিইজো মুরাকমি (১৮৬৫-১৯৩৮), স্যুইহা ওয়াতানাবে (১৮৮২-১৯৪৬), ফুউরা মায়েদা (১৮৮৪-১৯৫৪), দাকোত্স্যু ইঈদা (১৮৮৫-১৯৬২) এবং সেকিতেই হারা অন্যতম। এদেরকে ‘তাইশো হোটোটোগিশু’ নামে অবহিত করা হয়। এদের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো ঐতিহ্যবাহী ভাষাশৈলী ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সুরে প্রকৃতির বর্ণনা আর চিরন্তন ও রহস্যাবৃত অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।
নিঃসঙ্গতায় ও আবার ঘণ্টা বাজাল তুষারাবৃত পর্বতের উপরে
কাবিইয়া*র প্রহরী। চাঁদটি
(* হেমন্তে বন্যপ্রাণীতে ভীত করার জন্য বনের কুঁড়েঘরে জ্বালানো আগুন) ছুঁড়ে দিচ্ছে শিলাপিণ্ড।
হিসাজো স্যুগিতা (১৮৯০-১৯৪৬) ও অন্যান্য মহিলা কবি হাইকু রচনায় মহিলাদের এগিয়ে আনার জন্য হোটোটোগিশু পত্রিকার সম্পাদক কিয়োশি তাকাহামা পত্রিকাটিতে ‘রান্নাঘরের গান’ নামে একটি অংশ চালু করেন, যাতে মহিলারা হাইকু লিখতেন। এই অংশের কল্যাণে কানাজো হাসেগাওয়া (১৮৮৭-১৯৬৯) ও মিদুরিজো আবে (১৮৮৬-১৯৮০) ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মহিলা কবি আত্মপ্রকাশ করেন।
তারো পাতার উপরের শিশির উপত্যকার গভীর প্রত্যন্তে
পর্বতের ছায়া প্রজাপতি উড়ছে দেখ কতো উঁচুতে!— সেকিতেই হারা
বদলে দিলো তাদের ।— দাকোত্স্যু ইঈদা
অন্য মহিলা কবিদের মধ্যে হিসাজো স্যুগিতা হাইকু কবিতায় তার দক্ষতা ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন।
প্রথম হাইকুতে ‘পর্বতের ছায়া’ (দূরের চিন্তকল্প) এবং ‘তারো পাতার উপরের শিশির’ (নিকট চিত্রকল্প) এবং দ্বিতীয়টিতে ‘উপত্যকার গভীর প্রত্যন্তে’ (দূরের চিন্তকল্প) এবং প্রজাপতি (নিকট চিত্রকল্প) বাক্যগুলো লক্ষণীয়। আপাতবিচ্ছিন্ন এবং বিপরীতধর্মী দুটি চিত্রকল্পকে একসঙ্গে গ্রথিত করে, প্রার্থনাবেদিতে অর্পিত পুষ্পার্ঘের ভাবনা মনে বিকশিত করে দিয়েছে।
অথচ হিসাজোর হাইকুতে এই দুই ধরনের চিত্রকল্প কিন্তু মিলেমিশে এক হয়ে গেছে— (এর পর ৮-এর পৃষ্ঠায়)
(৯-এর পাতার পর)
হেমন্তের বিশুদ্ধ বাতাস
হাইড্রানজিয়া ফুলে এসে পৌঁছলো
শিনানো৮ গ্রামাঞ্চল।
সুজি তাকানো (১৮৯৩-১৯৭৬) তাইশো হোটোটোগিশু ভাবধারার কবিরা রোমান্টিক কল্পনাশ্রয়ী জোরালো শব্দের দ্যোতনায় অসাধারণ সব কবিতা লিখেছেন। কিন্তু এ ধারা বেশিদিন স্থায়ী না হয়ে অগভীর ভাবাশ্রয়ী কবিতা বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শোয়া কালের৯ প্রথমদিকে তাইশো হোটোটোগিশু ভাবধারা এক নতুন রূপ লাভ করে। কিয়োশি তাকাহামা এই ধারা চালু রাখতে ‘শাসেই’ সংযুক্ত করার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেন। এর ফলে শি-কি মাসাওয়া প্রবর্তিত নিয়মই আবার ফিরে এলো। এই ধারার অধীনে শুওশি মিজুহারা (১৮৯২-১৯৮১), সুজু তাকানো, সেইহো আওয়ানো (১৮৯৯-১৯৯২), সেইশি ইয়ামাগুচি (১৯০১-১৯৯৪), কুসাতাও নামামুরা (১৯০১-১৯৮৩) কবিদের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক কবিই ‘কিয়াক্কান শাসেই’ অবলম্বন করে নিজস্ব ধরন চালু করেন।
গ্রীষ্মের পর্বতের দিকে বসন্তের তুষার আলাদাভাবে
সে হেঁটে গেল তরঙ্গের মতো ঐ দূরে উড়ছে দেখ
বাগানের পথে। বেড়া পার হয়ে এলো। নববর্ষের একদল কাক।
এই পীচগুলি সবুজ মাকড়সা জালের একটি সুতা
আছে একটু লালের ছোঁয়া। শক্ত করে জড়িয়ে আছে
জলপদ্মের পাপড়িতে।
কো-ই নাগাতা (১৯০০-১৯৯৭) বাসো-র বিরুদ্ধে শি-কি মাসাওকার সমালোচনা সত্ত্বেও, বাসোর প্রতি সম্মানের কোনো ঘাটতি হয়নি। অপরদিকে, কেবল হাইকুর জগতেই নয়, জাপানি কবি হিসেবে তার সুনাম সবচেয়ে বিশ্বের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। এ কথা সত্য যে, বাসোর রসাত্মক ও নাটকীয় হাইকু কখনই তাইসো (১৯১২-১৯২৬) বা শোওয়া যুগে (১৯২৬-১৯৮৯) ‘আ-লা-মঁদ’ (অত্যাধুনিক) হয়ে ওঠেনি। কো-ই নাগাতা বাসোর পদ্ধতিই অবলম্বন করে হাইকু লিখেছেন। তিনি হোটোটোগিশু ধারার হাইকুর সমালোচনা করেছেন।
কাকিও তোমিজাওয়া (১৯০২-১৯৬২) হোটোটোগিশু পত্রিকার প্রভাবশালী সদস্য শুয়োশি মিজুহারা ১৯৩১ সালে পত্রিকা ছেড়ে চলে যান সুজু তাকানো ও কিয়োশি তাকাহামা প্রবর্তিত পদ্ধতির প্রতিবাদে। শুওশি ভেবেছিলেন যে, ‘কিয়াক্কান শাসেই’ (বস্তুনির্ভর রূপরেখা) ভোঁতা বৈচিত্র্যহীনভাবে বস্তুর বর্ণনানির্ভর হাইকুর জন্ম দিচ্ছে। তিনি আরও পরিপূর্ণ চিত্রকল্পসমৃদ্ধ হাইকু সৃষ্টি করার দাবি করেন। হাইকুর জগতে যে কিয়োশি বিচরণ করছিলেন, শুয়োশির এই বক্তব্যে এক বড় ধরনের আঘাত পড়ল।
নবীন কবিরা, এই ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও প্রগতিবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত করল, যে আন্দোলন ‘শিনকো হাইকু’১০ নামে পরিচিতি লাভ করল। শুয়োশি কিগোবর্জিত (ঋতু) হাইকু সমর্থন করেননি। তিনি বিষয় হিসেবে প্রকৃতি ও প্রকৃতিনির্ভর জীবন উপজীব্য হিসেবে বেছে নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। শিনকো হাইকুর কবিদের মধ্যে শানকি সাইতো (১৯০০-১৯৬২), কাকিও তোমিজাওয়া, হোসাকু শিনোহারা (১৯০৫- ১৯৩৬), সোশু তাকাইয়া (১৯১০-) এবং হাকুসে ওয়াতানাবে (১৯১৩-১৯৬৭) উল্লেখযোগ্য। কাকিও তোমিজাওয়া তার কবিতায় পাশ্চাত্যের মতো বিমূর্ত, সদৃশ্য ও রূপক ব্যবহার করেছেন।

ভিন্ন ভাষায় হাইকু
উনিশ শতকের শেষদিক থেকে ইংরেজি ভাষাভাষী পশ্চিমা দেশগুলোতে হাইকু অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বর্তমান সংঘাতময় দ্রুত সঞ্চারমান ও জটিল বিশ্ব পরিবেশের জটিলতায় আক্রান্ত এ কবিতার সংক্ষিপ্ততা ও আধ্যাত্বিক ঔজ্জ্বল্যের ক্ষুদ্র নিদর্শন ইদানীংকালের পাঠক ও শ্রোতাদের মনে অনন্য দ্যোতনার জন্ম দেয়। পোস্ট-মডার্নিজমের কিছু কিছু বিষয়ের সঙ্গে হাইকু উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক কবি, এল্যান ওয়াটস্, রবার্ট হ্যাসে এবং জ্যাক কেরোয়াক হাইকুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হাইকু লেখেন।
ঐতিহ্যবাহী জাপানি হাইকু ৫-৭-৫ অক্ষরমালায় সজ্জিত হলেও জাপানি ও ইংরেজি দুই ভাষার ব্যাকরণ ও ছন্দের পার্থক্যের কারণে অধিকাংশ ইংরেজি ভাষাভাষী লেখক ও অনুবাদক এই ধারায় কবিতা রচনা করতে পারেননি। ইংরেজি ১৭ অক্ষরমালা জাপানি কবিতার তুলনায় অত্যন্ত শাব্দিক হয়ে ওঠে, অথচ তা সংক্ষিপ্তও হয়ে ওঠে না। ফলে আধুনিক ইংরেজি ভাষাভাষী কবিরা সাধারণত সর্বাধিক ১৭ অক্ষরমালায় সীমাবদ্ধ থেকে কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করে থাকেন, অনেক ক্ষেত্রে তা ১১ থেকে ১৩ অক্ষরমালায় সঙ্কুচিত করার চেষ্টা করেন। তাদের ধারণা এভাবে তা’ জাপানি কবিতার অনেক কাছে যেতে পারেন, যদিও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট মতদ্বৈধতা রয়েছে।
অনেকেই ঐতিহ্যবাহী ১৭ অক্ষরমালাকে অনুসরণ করে হাইকু লেখায় অধিক রক্ষণশীল, অন্যদিকে, বিশেষ করে, যারা বর্তমানে ইংরেজিতে হাইকু লিখছেন, তারা এ ধারা ভেঙে দৈনন্দিন জীবনের অপ্রাকৃত চিত্রকল্প ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সময়ই বলে দেবে এই নতুন ধারা কতটা জনপ্রিয়তা পাবে।
প্রায় সব দেশে গড়ে উঠেছে হাইকু সমিতি, প্রকাশিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ, প্রকাশিত হচ্ছে বহু সাময়িকী আর গড়ে উঠেছে অনেক ওয়েবসাইট। এসব সমিতি, বই, সাময়িকী আর ওয়েব সাইটগুলোর মাধ্যমে শেখা যাবে ঐতিহ্যবাহীসহ সব ধরনের হাইকু লেখার নিয়ম। আবার এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে বা এখনও হচ্ছে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যাবে।
বাংলা সাহিত্যামোদিদের কাছে হাইকুকে পরিচিত করিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ শতকের প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণে গেলে তিনি জাপানি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালের ৭ নভেম্বর লিখলেন—‘এই লেখাগুলো শুরু হয়েছিল চীনে-জাপানে। পাখায়, কাগজে, রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধে এর উত্পত্তি। তারপরে স্বদেশে ও অন্য দেশেও তাগিদ পেয়েছি। এমনি করে এই টুকরো লেখাগুলি জমে উঠল। এর প্রধান মূল্য হাতের অক্ষরে ব্যক্তিগত পরিচয়ের। সে পরিচয় কেবল অক্ষরে কেন, দ্রুতলিখিত ভাবের মধ্যেও ধরা পড়ে। ছাপার অক্ষরে সেই ব্যক্তিগত সংস্রবটি নষ্ট হয়—সে অবস্থায় এসব লেখা বাতি-নেভা চীন লণ্ঠনের মতো হাল্কা ও ব্যর্থ হতে পারে। তাই জার্মানিতে হাতের অক্ষর ছাপাবার উপায় আছে খবর পেয়ে লেখনীগুলো ছাপিয়ে নেয়া গেল। অন্যমনস্কতায় কাটাকুটি ভুলচুক ঘটেছে। সে সব ত্রুটিতেও ব্যক্তিগত পরিচয়েরই আভাস রয়ে গেল।—শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নভ. ৭. ১৯২৬)’।

Thursday, January 12, 2012

জাপানি ছন্দঃ হাইকু

জাপানি ছন্দঃ হাইকু


আমি ছন্দ নিয়ে কিছু আলোচনা করে কিছু পোস্ট দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবো। কিন্তু আমার ছন্দ আলোচনা, বিশ্লেষণ অনেকেরই ভালো লাগে নি। এজন্য তারা আমাকে তাদের নানা মন্তব্যে আমাকে হেয় করবার চেষ্টা করেছে। তাই ভাবলাম ওদের ইচ্ছেরই প্রতিফলন ঘটুক, ওগুলো নিয়ে আর লিখবো না। তবে ছন্দের যে গভীর প্রেমে আমি মজেছি তাতে ছন্দ থেকে আমার দূরে থাকাটা হয়তো আর হবে না। আমি ছন্দ নিয়েই থাকবো তবে অন্যভাবে। smile :) :-)

প্রত্যেক সাহিত্যেই কবিতার ছন্দ-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় ঐ ভাষার দ্বারা, ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য দ্বারা। জাপানি ছন্দও এই নীতির ব্যতিক্রম না। জাপানি ভাষায় স্বরবর্ণ সংখ্যা মাত্র পাঁচটি। এগুলোর সবগুলোই হ্রস্ব। জাপানি ভাষায় কোন দীর্ঘস্বর কিংবা অই্‌, উউ্‌ এর মতন বদ্ধস্বর নেই। জাপানি ভাষায় কোন ব্যঞ্জনস্বরের উচ্চারণও হসন্ত যুক্ত না, অর্থাৎ সবই মুক্তস্বর, কোন বদ্ধস্বর নেই। তাই জাপানি সাহিত্যে ছন্দের হিসেবে কোন প্রকার জটিলতাই নেই। ফলে জাপানি সাহিত্যে ছন্দশাস্ত্রও খুব একটা গড়ে অঠে নি।


জাপানি সাহিত্যে কবিতাগুলো হয়ে থাকে খুবই সরল প্রকৃতির। ছন্দবৈচিত্রতার দরুন জাপানি ছন্দকে শ্রেণিকরণ করা যায় না, তবে মাত্রার পর্বসংখ্যা অনুযায়ী জাপানি কবিতাকে মোটামুটি পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় - হাইকু, তানকা, চোকা, সেদোকা এবং ইয়ামো।


হাইকু (একবচনে "হাইকি") একধরনের জাপানি কবিতা যাতে মাত্র তিনটি পঙ্‌ক্তিতে যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ মোরাসের মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি মুহূর্তে ঘটিত মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। সাধারণত একটি ছবি বর্ণনা করার জন্য হাইকু লেখা হয়ে থাকে। মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয়। কিন্তু ইযোরোপীয়রা ১৭ মাত্রার হিসেবে হাইকু লেখার সূত্রপাত করে। তাদের দেখাদেখি বাংলা ভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী ১২ মোরাসে ১৭ দল হয় ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ দলের পরিবর্তে আরো বেশী দলের হাইকু লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তাই তারা ১৭ দল ও তিন বাক্য বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লেখার সূত্রপাত ঘটান।


মাৎসু বাশো
র "old pond" বা পুরোনো পুকুর হাইকিটা দেখে নিইঃ
古池や蛙飛込む水の音
ふるいけやかわずとびこむみずのおと


উচ্চারণে একে বিন্যস্ত করলে পাইঃ

fu-ru-i-ke ya (৫)
ka-wa-zu to-bi-ko-mu (৭)
mi-zu no o-to (৫)


ইংরেজি অনুবাদঃ

old pond . . .
a frog leaps in
water’s sound


এর বাংলা রূপটা দাঁড়ায়ঃ

পুরোনো পুকুর
ব্যাঙের লাফ
জলের শব্দ।


এটা আক্ষরিক অনুবাদ, হাইকুর ছন্দ রক্ষা করা হয় নি।। হাইকুর ছন্দে রবি ঠাকুর একে ভাবানুবাদ করে লিখেছেনঃ

পুরোনো ডোবা,
দাদুরী লাফালো যে,
জলেতে ধ্বনি।



এবার এই ছবিটার বর্ণনা করে একটা হাইকির চেষ্টা করিঃ

বাদরো ঝরে
কালো কাকেরো 'পরে,
ভিজে গেলো যে!

Tuesday, January 10, 2012

হাইকু সিরিজ

হাইকু সিরিজ

-

১.
রাস্তা ছেঁড়া
অপলক নজর
খুঁজছে ডেরা ।।
২.
পিঁপড়ে দল
খাবার দেখলেই
নেবার ছল ।।
৩.
শীতের মাস
মাঠে ও ময়দানে
সবজি চাষ ।।
৪.
নয়া পরব
পোড় খাওয়া মাটি
হলো সরব ।।
৫.
ভ্রান্ত রথ
চলছে অগোছালো
হারাবে পথ ।।
৬.
বৃষ্টি-জল
স্ফটিক-সদৃশ
শীত-শীতল।।
৭.
মাছের ঝাঁক
স্রোতের বিপরীতে
নিয়েছে বাঁক ।।
৮.
জংলী ঘাস
আপনিই গজায়
করি না চাষ।।
৯.
কচুর পাতা
বাদল বরিষণে
ওটাই ছাতা।।
১০.
প্রাচীন বট
ধূসর পৃথিবীতে
সবুজ পট ।।
১১.
চতুর কাক
ভাতের ধান্ধায়
করছে হাঁক ।।
১২.
শিমুল তুলো
হাওয়ায় উড়লে
নরম ধুলো।।