Saturday, July 25, 2009

হাইকু এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

হাইকু এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

sknazrul লেখক শেখ নজরুল

‘হাইকু’ জাপানি কবিতার একটি জনপ্রিয় ধারা। হাইকু, ‘হক্কু’ কিংবা ‘হাইকাই’ নামেও লেখা হয়েছে। হাইকুকে ‘রেঙ্গা’ নামেও অবিহিত করা হয়েছে। প্রচলিত হাইকুর গঠনশৈলী ৫-৭-৫, ৭-৭। ৫-৭-৫ গঠন শৈলীর রেঙ্গাকে বৃহদ পর্ব এবং ৭-৭ গঠন শৈলীর রেঙ্গাকে ছোট পর্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে প্রকৃত হক্কুর বিষয় এবং বাস্তবতা আজো বিতর্কিত হলেও ধারণা করা হয় যে, রেঙ্গা নামটি জাপানি কবিতার ধ্রুপদি ধারণা থেকে নেয়া হয়েছিল যার শুরুর প্রক্রিয়া মননশীন চিন্তার রূপকল্প। তবে শুরুতে লেখার প্রক্রিয়াগত বিষয়বস্ততে কিছুটা সৃজণশীলতার অভাব ছিল। আধুনিক হাইকুর কবিরা প্রকৃতি রোমান্স, সেক্স, সহিংসতা, সমাজঘনিষ্ট বিষয়বলী তাদের হাইকুর অবয়বে তুলে ধরলেও প্রাচীন লেখকরা এটি পরিহার করতেন। ফলে তাদের লেখায় দুবোর্ধ্যতার বিষয়টি পরিলতি ছিল। আধুনিক হাইকু দুর্বোধ্য নয় ববং এটি পাঠকের কাছে ভীষণ সহজবোধ্য এবং জীবন ঘনিষ্ঠ। প্রাচীন হাইকুর কবিরা লেখার সংখ্যা বৃদ্ধিতে বেশি উৎসাহী ছিলেন কিন্তু আধুনিক কবিরা সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে এর সাহিত্যমূল্যের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আধুনিক এবং প্রাচীন দু’টি হাইকু থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
প্রচীন- ‘এ সড়কে কোথাও
কোন জীবন নেই তবু
শরতের সন্ধ্যা আসে’
(মূল : মাতস্যুও বাশো/ অনুবাদ : লেখক)

আধুনিক- ‘মৃত্যুর সংবাদগুলো
ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে
ছাপার অরে’
(মূল : ক্রিস্টেন ডেমিং/ অনুবাদ : লেখক)
উল্লেখিত প্রথম হাইকুটির চেয়ে দ্বিতীয়টি অনেক বেশি সমৃদ্ধ এবং তা গতানুগতা থেকে গতিশীলতা পেয়েছে। যা অন্তত ‘আহ!’ জাতীয় শব্দ দিয়ে শুরু হয়নি। তাই সবার পে একজন শক্তিশালী হাইকু লেখক হওয়া সম্ভব নয়।
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে প্রখ্যাত হাইকু লেখক মাসাওকা শিকি হক্কুর পর্ব শুরুর বিষয়টি পরবর্তী পর্বের সঙ্গে যথাযথ লিংক স্থাপনের জন্য কাজ করেন। জাপানি ভাষায় ‘অন’ অর্থ শব্দ। এবং ‘অনজি’ হচ্ছে শব্দপ্রতীক। কিংবা মোজি অরপ্রতীক। যা প্রায়শ হাইকুর বাক্য বিন্যাসের একটি মূল উপাদান। আধুনিক হাইকু সচারচার তিনটি বাক্যে লেখা হয় যা ব্যকরণগত দিকটি বজায় রাখার প্রয়োজন মনে করে না। জাপানীতে এটিকে কিরিজি বলে। ইংরেজিতে লেখা হাইকুর বাক্যগুলোতে হাইপেন ব্যবহৃত হতে পারে। তবে পুরাতন ঢঙে লেখা হাইকু যা প্রকৃত হাইকু হিসেবে পরিচিত তা আধুনিক ঢঙের মুক্ত হাইকুকে সমর্থন করে না। জাপানি হাইকু এক লাইনে লেখা হলেও ইংরেজি ভাষায় তা তিন লাইনে লেখা হয়। জাপানীতে নামপদ একবচন-বহুবচনে অলাদাভাবে ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু ইংরেজিতে একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়।
যেমন ‘ফুরু ইকি এ্য কাউয়াজু তবিকোমু মিজু নো ওতো’ (জাপানি ভাষায়)
‘ব্যাঙের লাফে পানিতে শব্দ হলো’
১৪০০ সালে প্রথম হাইকু সমগ্র প্রকাশ করেন জাপানী কবি স্যুকুবাশু। ১৯০০ সালে রেঙ্গাহীন হাইকু প্রকাশিত হয়। জাপানের মাতস্যুও বাশো (১৬৪৪-৯৪), তানিগুচি বুসন (১৭১৬-১৭৮৪), কোবাইয়াশী ইছা (১৭৬৩-১৮২৭), সিকি মাসাউকা (১৮৬৭-১৯০২), কোওশি তাকাহামা (১৮৭৪-১৯৫৯), ইপিকিরো নাকাতসুকা (১৮৮৭-১৯৪৬), সিকিতিই হারা (১৮৮৯-১৯৫১), হাইসাজো সুগিতা (১৮৯০-১৯৪৬) আট প্রথিতযশা কবি হাইকু রচনা করেছেন। বর্তমানে হাইকুর বিষয়বস্তুর সঙ্গে ছবি আঁকাসহ অন্যান্য শিল্পের ব্যবহারও চলছে। জাপান ছাড়াও ১৯ শতকে পাশ্চত্যের কিছু দেশে হাইকু চর্চা শুরু হয়। বাসিল হল (১৮৫০-১৯৩৫) এবং উইলিয়াম জর্জ অস্টনের মতো কবিরা হাইকুর কাব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কাজ করেন। জাপানি কবি অনি নোগোচি ১৯০৪ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘এ্য প্রপোজাল টু আমেরিকান পোয়েট’ রচনা করেন। যা রিডার ম্যাগাজিনের ফেব্র“য়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘এ্য প্রপোজাল টু আমেরিকান পোয়েট’এ তিনি লেখেনÑ ‘আমার আমেরিকান কবি বন্ধুরা প্রার্থণা করো, জাপানি হক্কুর জন্য চেষ্টা করো’।
ফ্রান্সে পল লুইস ১৯০৬ সালে হাইকুকে পরিচিত করান। ম্যাক্সিকান নোবেল বিজয়ী কবি অক্টাভি পাজ ইকিচি হায়াশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজি ভাষা থেকে স্পেনিশ ভাষায় হাইকু অনুবাদ করেন এবং তা প্রকাশ করেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় অনুবাদে এটি বেশ পিছিয়ে ছিল। ১৯৪৯ সালে ইংরেজ কবি আর.এইচ ব্লিথ চার প্রস্থে হাইকু গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ‘হাইকুর ইতিহাস’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। বিখ্যাত কিছু হাইকুগ্রন্থ হচ্ছেÑ কুনিহারু শিমিজুর ‘হাইকু ফর এ্য মুনলেস নাইট’, আকিতো আরিমাসের ‘আকিতো আরিমাস হাইকু’, ফে ওয়াজির ‘ক্রিস্মাথিাম লাভ’ এবং ‘আন ব্রোয়ার্ড স্যুজ, ব্যাক রোড টু ফার টাউন, ডেভিড কবের ‘পাম’, মাকোতা ওদারের ‘ডিউ অন দ্য গ্রাস’, অনিতা ভার্গিলের ‘এ্য লং ইয়ার’।
হেন্ডারসন ইংরেজিতে হাইকু অনুবাদ করেন। তিনি তার অনুবাদে ছড়ার মেজাজ বজায় রেখে এ-বি-এ শৈলী ব্যবহার করেন। অথচ জাপানি কবিরা কখনই ছড়ার ধারা বজায় রাখেননি। জাপানি কবি আসুদা হাইকুর ফর্মে ১৭ শব্দের চেয়ে ইংরেজি সতের শব্দ বিস্তৃত হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিখ্যাত বুদ্ধিষ্ট কবি এবং শিল্পী পল রেপ্স (১৮৯৫-১৯৯০) হাইকু-লাইক’ প্রবন্ধে হাইকুর বর্ননা দেন। ১৯৯১ সালে উত্তর আমেরিকায় কবি, অনুবাদক গালর্ড ভিজনর, গর্ডন হেনরী, ব্লেজারসহ অন্যান্য লেখকদের নিয়ে প্রথম হাইকু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাম্প্রতিকসময়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় হাইকু রচিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে জাপান, দ্বিতীয় পর্যায়ে ইংরেজি ভাষাভাষিসহ জার্মানী এবং ব্রাজিল হাইকু নিয়ে চর্চা শুরু করেন।
১৯৭০ সালে একজন ফরাসি সমালোচক ‘এমপায়ার অব সাইন’ প্রবন্ধে বলেনÑ হাইকু হচ্ছে ‘মাটির ওপর শিশুর আঁচড় কাটা; যেখানে সে বলতে চায় এটি কেমন করে হয়?’
বাংলাদেশে হাইকু চর্চা খুববেশি লক্ষণীয় নয়। প্রায় বারো বছর আগে লেখা বিশিষ্ট সাহিত্যিক হাসনাত আব্দুল হাই’র লেখা হাইকু গ্রন্থটি নজরে আসে। এর পর কিছু লেখক হাইকুকে মূল লেখা হিসেবে না নিয়ে অনুবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত চঞ্চলা চঞ্চুর ‘বেহুলার শাড়ি পোড়ে’ শীর্ষক হাইকুর মূল রচনা নিশ্চয়ই সমৃদ্ধ রচনা।

চঞ্চলা চঞ্চুর হাইকু

হাইকু ॥ ঊনিশ

গোপনে ছুঁইবো, কেউ কিছু কইবে না।
গোপনে শুইবো তওবা পড়িলে মাফ হইবে না?
গোপনে ধুইবো বাতাসে সত্য বইবে না।

হাইকু ॥ আটাশ

কিসের গন্ধ?
বিষের গন্ধ?
প্রেমিক ফুটেছে ভালোবাসা গাছে।


হাইকু ॥ ঊনত্রিশ

তোমার ত্রিসীমায় যাব না, হব না পানকৌড়ি ফের
ওখানে পোড়ে শ্মশ্বান, লাশ পোড়ে না, যাব না!
ওখানে ওড়ে আঙরা, ছাই ওড়ে না, যাব না। 

 

nazlaabedin ফাতেমা আবেদীন নাজলা২৮ জুলাই ২০০৯ কবিতার অনেক কিছুই কম বুঝি, তার পর ও একটা কিছু বোঝার ইচ্ছায় একটা প্রশ্ন করতে চাই। আমি হাইকু বলতে যেটা বুঝি -এটা একটা জাপানিজ কবিতা লেখার ধারা যেখানে তিনটা ছন্দহীন বাক্য একটা পূর্ণ অবয়ব নিয়ে আসবে । এবং এই অবয়বের শব্দমাত্রা হবে ৫-৭-৫। কবি চঞ্চলা চঞ্চু প্রথম শর্ত পূরণ করলেও ২য়টিতে একটু কি কার্পন্য করেন নি? এটাই প্রশ্ন। আমার বোঝার অজ্ঞতাও থাকতে পারে। একটু শব্দমাত্রা, বিষয়টা বুঝিয়ে একটা পোস্ট দিবেন কি? 

 

sknazrul শেখ নজরুল২৮ জুলাই ২০০৯

প্রথমত আমি আপনার জন্য একটি পোস্ট দিয়েছি। আশাকরি পড়বেন শিরোনাম মধ্যরাতের গদ্য। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশে এই মাত্রা মেনে হাইকু লেখা হয় না। এবং এই বিষয়টিই খুব বেশি লেখা হয়নি। আমার ছন্দ সর্ম্পকে সামান্য যে জ্ঞান তাতে এইটুকু বোঝাতে পারি- এখানে সাধারণত ৩ টি ছন্দে কবিতা লেখা হয়। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত। অক্ষর বৃত্তের মূল কাঠামো হচ্ছে- ৮+৪+৬, ৮+৬, ৮+৪ ইত্যাদি। যেমন আমার একটি লাইন থেকে যদি উদাহরণ দিই- অতৃপ্ত অন্তর জ্বলে গণেষের লুকানো যৌবণে/ হায় কলাগাছ বউ তুমি কার মেটাবে সঙ্গম.....। খেয়াল করুন, অতৃপ্ত অন্তর জ্বলে =৮, গণেষের=৪, লুকোনো যৌবণে=৬, মাত্রাবৃত্ত একটু সহজ অক্ষর গুণে মাত্রা যেমন- সংসার বলো ভালোবাসা বলো/ কবিতাকে বলি তার আগে চলো/..। এখানে প্রথম লাইনে ৬ মাত্রা পরের লাইনেও ৬ মাত্রা। যদি যুক্তাক্ষরও হয় তাও ভেঙে গুণতে হবে। স্বরবৃত্তের উদাহরণে বলা যায়, প্রথমে বদ্ধাক্ষর হলে একমাত্রা পরেরও যদি তাই হয় তবেও একমাত্রা, অথ্যাত যেখানে বাধা পাবে সেখানেই এক মাত্রা। মুক্ত হলে অক্ষর গুণে মাত্রা। যেমন, ঘটি চালান বাটি চালান/ কোন চালানে যাবো/ হাতঘড়িটা কষ্ট পেলে/ তোমায় আমি খাবো/ ... এখানে ঘটি = ২ মাত্রা, চা=১ লান=১ যেহেতু বদ্ধার মোট ৮ মাত্রা। পরের লাইনেও ৮ মাত্রা আছে। মোটামুটি এ রকমই তবে অতিরিক্ত মাত্রা জাতীয় কিছু সমস্যা আছে। দুঃখিত যদি বেশি লিখে থাকি।

Source: http://prothom-aloblog.com